করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই ডেঙ্গুর থাবা

করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই ডেঙ্গুর থাবা।করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে চলমান কঠোর লকডাউন পরিস্থিতিতে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ আবির্ভূত হচ্ছে। মহামারী করোনার সংক্রমণে নাস্তানাবুদ পুরো দেশ। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। এরই মধ্যে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।  করোনার সাথে ডেঙ্গু মারাত্মক রূপ নিলে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।গত এক সপ্তাহ ধরেই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন ১৮৯ জন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে মশার উপদ্রবও। যদিও মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা দুই সিটি করপোরেশন দাবিকরছে, মশক নিয়ন্ত্রণে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। সেই সময় ৫ হাজার ৫১১ রোগী ভর্তি হয়েছিল, আর মারা যান ৯৩ জন। ওই বছরই রোগটি প্রথম ভয়াবহ আকার নেয়।এর পর ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ও এতে মৃত্যু কমে আসে। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বছরে আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের নিচে থাকে, মৃতের সংখ্যাও ছিল খুব কম। ২০১৬ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়ালেও পরের বছর আবার কমে যায়। এর পর আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে ২০১৮ সালে, ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৬ জন। আর গত বছরে প্রাদুর্ভাব বেড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ডের জন্ম দেয়। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ১৪৮ জনের ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে সরকারের খাতায়। সেখানে গত বছরের আগস্টেই আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন।

করোনাপূর্ববর্তী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত বিষয় ছিল ডেঙ্গু। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে এক লাখেরও বেশি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৪৮ জন। যদিও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে আড়াইশর বেশি মানুষের এই রোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত রোগী কখনই হাসপাতালে ভর্তি হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩২ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৯, মার্চে ১৩, এপ্রিলে ৩, মে মাসে ৪৩, জুনে ২৭১ এবং চলতি মাসে গতকাল পর্যন্ত ৩৫৫ জন।এছাড়া দৈনিক হিসেবে গত এক সপ্তাহে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও। এর মধ্যে গত ৫ জুলাই ৩৮, ৬ জুলাই ৩২, ৭ জুলাই ২৮, ৮ জুলাই ৩৬, ৯ জুলাই ২৪, ১০ জুলাই ৪৮, গতকাল ১১ জুলাই ৫৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এদিকে মশার উপদ্রব বাড়ছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। অনেক স্থানে দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তারা বলছেন, গত এক মাস ধরে মশার উপদ্রব বেড়েছে। দুই বেলা মশার ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও অনেক স্থানে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। কোথাও কোথাও সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটানো হয়। অনেক স্থানে নামকাওয়াস্তে প্রধান সড়ক ধরে ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়িয়েই দায়িত্ব শেষ করেন মশককর্মীরা।জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পরেই মশক নিধন কার্যক্রমকে ঢেলে সাজান। এর অংশ হিসেবে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রতিদিন চার ঘণ্টা প্রতি ওয়ার্ডে নির্ধারিত আটজন মশককর্মী বিভিন্ন স্থানে লার্ভিসাইডিং চালু করেন। অন্যদিকে দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এডাল্টিসাইডিং করা হয়।

তবে সরেজমিন বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে মশক নিধন অভিযানে গাফিলতি এসেছে। শুরুর দিকে মশককর্মীরা নিয়মিত ওষুধ ছিটালেও বর্তমানে সেভাবে ওষুধ ছিটানো হয় না। ফলে মশার উপদ্রব আবার বেড়েছে।দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ ও অঞ্চল ৪-এর আওতাধীন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, খাতাকলমে প্রতি ওয়ার্ডে আটজন মশককর্মী কাজ করার কথা থাকলেও বাস্তবে তেমন দেখা মেলেনি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও বিষয়টির সত্যতা মিলেছে।এদিকে মশক প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে চলছে মোবাইল কোর্ট। করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলেই এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।

অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ১০টি অঞ্চলের ৫৪টি ওয়ার্ডে একযোগে আজ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত শুক্রবার ব্যতীত ৮ দিনব্যাপী মশক নিধনে চিরুনি অভিযান পরিচালিত হবে।ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার এ বিষয়ে বলেন, ডেঙ্গুর অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঢাকা ও আশপাশে অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের ধারণা, সামনের দিনে আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নিয়েছে। হয়তো কমতেও পারে। তবে শুধু অভিযানে নাগরিকদের জরিমানা করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কেবল বাসাবাড়িতেই এডিশ মশা জন্ম নেয় না। রাস্তাঘাট, টার্মিনালসহ নানা খোলা জায়গা রয়েছে, সেগুলো পরিষ্কারে মনোযোগ দিতে হবে। নাগরিকদের চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি করপোরেশনের দায়িত্বও যথাযথ পালন করতে হবে।

এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। নতুন কোনো উদ্যোগ না থাকলেও মশককর্মীদের কাজ কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি সব ওয়ার্ডে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে।উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের লক্ষ্যে নগরবাসীর প্রতি আমার আহ্বান ‘তিন দিনে একদিন, জমা পানি ফেলে দিন’। তিনি বলেন, ডিএনসিসি এলাকার যেসব ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়া রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, সেই তথ্য ডিএনসিসিতে সরবরাহ করা হলে সংশ্লিষ্ট রোগীর বাড়ি ও তার আশপাশে মশার ওষুধ স্প্রে করা হবে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, ডেঙ্গু এখন পর্যন্ত আতঙ্কিত হওয়ার মতো অবস্থায় আসেনি। এডিস মশা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অল্পসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু মারাত্মক রূপ নিলে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই আমি, মেয়র, কাউন্সিলর, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ মাঠে নেমে অভিযান শুরু করেছি।

Exit mobile version