এক্সক্লুসিভজাতীয়

লকডাউন ভেঙে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বাবুনগরীর বৈঠক

*গত ৫ জুলাই একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হেফাজতের বিতর্কিত আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে আওয়ামী লীগে তোলপাড় চলছে। দেশে যখন কঠোর লকডাউন চলছে সেই সময়ে জুনায়েদ বাবুনগরী কিভাবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন এবং ঢাকায় এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় লকডাউন ভেঙে বৈঠক করলেন তা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন যে, বারবার হেফাজতের সাথে এধরনের বৈঠক আওয়ামী লীগের আদর্শ, চিন্তা চেতনার পরিপন্থী। এ ধরনের বৈঠক আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। হেফাজতের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যেখানে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার হেফাজতের সাথে কেন বৈঠক করছেন তা নিয়েও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করছেন যে, এই সমস্ত বৈঠক জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। উল্লেখ্য যে, এর আগেও হেফাজতের নেতাদের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বৈঠক করেছিলেন। তবে সেসব বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরী উপস্থিত ছিলেন না।*

*হেফাজত মহাসচিব জেহাদীর নেতৃত্বে হেফাজতের নেতৃবৃন্দ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকগুলোতে কি ধরনের কথাবার্তা হয়েছিল সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তবে হেফাজতের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে তারা আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার দাবি করেছে। উল্লেখ্য যে, গত মার্চে হেফাজত সারাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দেশের অন্তত তিনটি স্থানে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এরপর সরকার কঠোর অবস্থানে যায়। এরকম ঘটনা নিয়ে যখন সরকার এবং হেফাজতের মধ্যে টানটান উত্তেজনা ঠিক সেইসময় এক নারী নিয়ে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন হেফাজতের তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। মামুনুল হকের এই ঘটনার পর সরকার হেফাজতের বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে এবং একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেপ্তার অভিযান এখনো চলমান রয়েছে। হেফাজতের হিসেব অনুযায়ী তাদের অর্ধশতাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, হেফাজতের কোনো নেতা হিসেবে কাউকে ধরা হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনিয়ম এবং বিভিন্ন রকমের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।*

*এই সময়ই ২০১৩ সালে হেফাজত যে ঢাকা শহরের তাণ্ডব চালিয়েছিল সেই মামলাগুলোকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল এবং সেই মামলাতেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এসব আটককৃতদের অনেকে জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। তাছাড়া ২০১৩ তেও যে মামলা সেই মামলায় জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ছিল এবং সে সময়ে জুনায়েদ বাবুনগরী গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। তাই প্রশ্ন উঠেছে হেফাজতের ওপর যখন চাপ তৈরি হয় সেই সময় হেফাজতের বিতর্কিত আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী তার কমিটি ভেঙে দেন এবং তিনি একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই আহ্বায়ক কমিটি থেকে আবার তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেছেন। আর সেই কমিটি নিয়েই হেফাজতের মধ্যে এখন মতবিরোধ এবং টানাপোড়েন চলছে।*

*এরকম একটি পরিস্থিতিতে হেফাজত যখন মৃতপ্রায় এবং হেফাজত যখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে সেই সময় স্বরাষ্টমন্ত্রী করোনার কঠোর লকডাউনের মধ্যে কেন হেফাজতের সাথে বৈঠক করলেন তা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই মনে করছেন যে, এই বৈঠক আওয়ামী লীগের জন্য কখনোই ইতিবাচক হবে না। হেফাজতকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে আওয়ামী লীগ কখনো লাভবান হতে পারে না। হেফাজত কখনোই আওয়ামী লীগের বন্ধু হতে পারে না। অবশ্য এসব নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী`র বা আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন যে, বাবুনগরীর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের বিষয়টি দ্রুতই খোলাসা হওয়া দরকার।*

*কঠোর লকডাউনে বাবুনগরীর ‘নগরে নৈশবিহার’*

*বিষয়টি আসলে বেশ অস্বস্তিকর। না, ভুল বলা হচ্ছে। বিষয়টি যতটা না অস্বস্তিকর, তারচেয়েও বেশি অস্বস্তিকর হচ্ছে এর পেছনে যিনি আছেন, তার নামটি। সারাদেশে চলছে কঠোর লকডাউন। যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের জীবিকার জন্যই ঠিকমতো ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না, ঠিক সেখানে হেফাজত ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী নগরে নৈশবিহারে বের হচ্ছেন যেন! কী বিষয়ে কথা হচ্ছে, কেন তিনি তার দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকছেন।*

*গত সোমবার (৫ জুলাই) রাত ৮টা ৩৭ মিনিটে মন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় যান হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। তার নেতৃত্বে আরও উপস্থিত ছিলেন মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদি ও হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর একান্ত সহকারী শফিউল আলম। প্রায় ২ ঘণ্টার বৈঠকে শেষে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা বের হয়ে যান। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।*

*এবার একটু জুনায়েদ বাবুনগরীর অতীতের দিকে যাওয়া যাক:*

*২০১০ সালে বাবুনগরীকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে ফজরের নামাযের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়দাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারাদেশ থেকে আসা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক। বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবরোধকারীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়াতে থাকলো, যখন এর নেতৃত্ব ঢাকার ভিতরে প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। তখনকার টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা আশা করি পাঠক এখনও ভুলে যাননি। শাপলা চত্বরে তাণ্ডব থেকে শুরু করে সর্বশেষ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলামের সহিংসতার নেপথ্যে ছিল সরকার উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।*

*২০১৭ সালে এসে বাবুনগরী ১৪ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে মাদ্রাসার দায়িত্ব মজলিসে শুরাকে দিয়ে দেন। ওই দিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে বাবুনগরীসহ তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। তিনি মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।*

*২০২০ সালের ২ অক্টোবর এক সভায় এসে বাবুনগরী এক সভায় বলেন প্রয়োজনে আরও দশটা লং মার্চ করতেও তিনি রাজি আছেন। বিদআত, শিরককারী, কাদিয়ানি এদের বরদাস্ত করা হবে না বলে তিনি আরও দশটি লংমার্চ করার জন্য প্রস্তুত আছে বলে জানান।*

*এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথার বিপরীতে কথা বলেও তিনি একধরণের সমস্যা তৈরির চেষ্টা করেন। নারীদেরকে বোরখা পরার জন্য একধরণের বাধ্যতামূলক কথা বলেন বাবুনগরী। নাস্তিকদের দেশ থেকে বিতারিত করবার জন্যও তিনি কঠোর ভাষায় এমন কিছু কথা বলেন, যা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে বিদ্বেষ ও রোষ প্রচারণার নামান্তর।*

*সরকারকে চাপে ফেলার জন্য হেন প্রতিহিংসামূলক এবং উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের চিন্তা নেই, যা বাবুনগরীর উর্বর মস্তিষ্ক থেকে প্রস্ফুটিত হয়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে হেফাজত কঠোর হরতাল ও আন্দোলনের ডাক দেয়। যেখানে সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দে নগরবাসীর আনন্দে মশগুল থাকার কথা, সেখানে রাজধানীকে ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত করে জুনায়েদ বাবুনগরী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে নানা ইস্যু তৈরি করা হয় এবং ইন্ধন জোগায় হেফাজতে ইসলাম। এমনকি রক্তের বদলা নেয়ার মতো প্রতিহিংসামূলক বাণীও শোনা যায় জুনায়েদ বাবুনগরীর উদাত্ত কন্ঠে।*

*সে-ই জুনায়েদ বাবুনগরী যখন কঠোর লকডাউনের মাঝে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান শহরে, সেক্ষেত্রে একটু অস্বস্তিতেও পড়তে হয় বৈকি। কারণ, তার মস্তিষ্কে কী চলছে, তা ঠাহর করা বেশ মুশকিল। গণমাধ্যমের সাথেও কথা বলতে নারাজ ছিলেন তিনি। বৈঠকে অংশ নিতে সোমবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন জুনায়েদ বাবুনগরী। এরপর তিনি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি মাদরাসায় বিশ্রাম নেন। এরপর সেখান থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিশ্রাম নিতেও কসুর করেন না। তার কর্মকাণ্ড দেখলে নগরবাসীর অবাক হতে হয়, এই বাবুনগরী কি আসলে আইনের নীতির তোয়াক্কা করেন না?*

*স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে দেখা করার অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয়। বৈঠকে বাবুনগরী উল্লেখ করেন কওমি মাদ্রাসা খুলে দেয়ার কথা, মাদ্রাসাদের শিক্ষার্থীদের কুরবানীর ঈদের সময়ে চামড়া সংগ্রহের কাজে সহায়তা করার কথা ইত্যাদি। বাবুনগরীর কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় তিনি এলাম, কথা বললাম, চলে গেলাম- এমন একটি অবস্থায় নিজেকে ভাবছেন। যখন ইচ্ছা আসা, যখন ইচ্ছা চলে যাওয়া- এসবের মধ্যেই আছেন তিনি। দেশে যে চলমান একটি পরিস্থিতি চলছে, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, এটি নিয়ে কিছু বলা তো দূরে থাক, বিধিনিষেধেরও কোনো তোয়াক্কা করেন না বাবুনগরী। কী এমন জরুরী প্রয়োজন ছিল বাবুনগরীর? সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেও কেন তিনি অনীহা প্রকাশ করলেন?*

*প্রশ্ন অনেক। উত্তরের খোঁজে আছে দেশ। উত্তরগুলো আশু পাওয়াটাই সবার জন্য মঙ্গল, বিশেষ করে দলটির নাম যখন হেফাজতে ইসলাম আর নেপথ্যে জুনায়েদ বাবুনগরী!*

Back to top button