অনেকেই মনে করেন যে, টানা ১২ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ, একা। বিশেষ করে মহাজোটকে অকার্যকর করে রাখা, ১৪ দলকে সক্রিয় করে না রাখা, মন্ত্রিসভায় কোন শরীরকে না রাখার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যে একলা চলো নীতি গ্রহণ করেছে তাতে আওয়ামী লীগ নিঃসঙ্গ একাকী হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এটাও বলা হচ্ছে যে আওয়ামী লীগের এই একলা চলো নীতির কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জোট তত্ত্ব এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার কৌশলটি পরিবর্তন করেছে। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে তাদের কিছু কিছু অনুগত রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেছে যারা প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচক কিন্তু মূলত তারা আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কাজ করছে। তারা বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সংকটে বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলে এবং বিরোধীদলে থেকে আওয়ামী লীগের উপকার করে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখছেন, ২০১৮ সালের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনকে।
২০১৮ এর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সবগুলো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের মিছিলে নিয়ে আসতে পেরেছিল। এটি আওয়ামী লীগের একটি বড় অর্জন ছিল। সেই সময়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল সংগঠন গণফোরাম এবং ড. কামাল হোসেন কার্যত আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছেন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গঠন পরিকল্পনায় যে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল, সেটি বোঝা যায় যখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিষ্ঠালগ্নে সক্রিয় থাকা বিকল্পধারার নেতা অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী মহাজোটে যোগ দেন তখনই।
কাজেই আপাতদৃষ্টিতে সরকার বিরোধী এবং সরকারের কঠোর সমালোচক হিসেবে বিবেচিত হলেও আদতে সরকারে বি টিম হিসেবেই তারা কাজ করছেন। এরাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মনে করছেন বিএনপির সহ অনেক রাজনৈতিক দল। এ কারণেই আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপির দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এখনো কাটেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বেশকিছু বি টিম রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণফোরামের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ গণফোরামের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে একাধিক রাজনৈতিক সূত্র মনে করছে। জাতীয় গণফোরামের একাংশের নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। তিনি একদিকে যেমন সরকারের সমালোচনা করছেন, অন্যদিকে বিএনপি জামাতের রাজনীতিরও সমালোচনা করছেন।
অনেকেই মনে করেন যে, গণফোরাম ভাঙ্গার পেছনে আওয়ামী লীগের হাত থাকলেও থাকতে পারে। গণফোরাম ভাঙ্গার পরে দুই পক্ষই এখন আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের আরেকটি বি টিম হিসেবে চিন্তা করা হয় বিকল্পধারাকে। বিকল্পধারা ২০১৮ এর নির্বাচনের আগে এক বছর সরকারের কঠোর সমালোচক ছিল। তারপর তাদেরকে যখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নেয়া হয়নি তখন তারা মহাজোটে যোগ দেয়। বাইরে সরকারের সমালোচনা করলেও আসলে সরকারের সঙ্গে বিকল্পধারার গোপন সম্পর্ক রয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।
এলডিপি: কর্নেল অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি সরকারের কঠোর সমালোচক। ২০ দলের অন্যতম শরিক জোট। কিন্তু সরকারের যতটা সমালোচক, তার চেয়ে বিএনপির বেশি সমালোচক এই দলটি। বিএনপির নেতৃত্বে পরিবর্তন এবং বিএনপির মধ্যে নতুন ধারার সৃষ্টির জন্য তিনি বেশি কথা বলেন। এজন্য অনেকে মনে করে যে কর্নেল অলি আহমেদ আসলে আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কাজ করছেন।
কল্যাণ পার্টি: কল্যাণ পার্টিকেও মনে করা হয় আওয়ামী লীগের আরেকটি বি টিম। বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলো আসলে বিরোধীদলের ভাঙ্গন, বিশেষ করে বিএনপিতে ভাঙ্গনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি ভাবে যুক্ত।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সরকারের কঠোর সমালোচক। কিন্তু একই সময়ে তিনি তারেক জিয়া সহ বিএনপির বিভিন্ন ইস্যুর সমালোচক। তিনি প্রকাশ্যেই তারেক জিয়ার নেতৃত্বে মেনে নিতে অস্বীকার করেন।
আর এই সমস্ত বি টিমের কারণেই আওয়ামী লীগের এখন জোট বা মহাজোটের প্রতি গুরুত্ব নেই। বরং আওয়ামী লীগের যে গোপন এজেন্ট বা সংগঠনগুলো আছে, সেই সংগঠনগুলোকে পরিচর্যা করার মাধ্যমে বিরোধী দলের ভিতর তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে রাখাই আওয়ামী লীগের প্রধান কৌশল বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। এর ফলে বাংলাদেশের সরকার বিরোধী বড় আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা একেবারেই যেমন কমে যাবে, তেমনি বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও নানা রকম সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।