দিন দিন বাড়ছে দেনার অঙ্ক,খাদের কিনারে আরেক লিজিং প্রতিষ্ঠান

এমডির পদত্যাগ আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

নানা অব্যবস্থাপনায় বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে না! ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণও পরিশোধ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। দায় এড়াতে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল হামিদ মিয়া। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এমডি যেন কোনোভাবেই পদত্যাগ করতে না পারে, সেই বিষয়ে পর্ষদকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাধারণ আমানতকারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং। অর্থ সংকটে এতদিন ঋণের মূল অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটি এখন সুদের টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না। দিন দিন বাড়ছে দেনার অঙ্ক। এমন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিতে গত ডিসেম্বরে প্রশাসক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের ঘটনা এই প্রথম। প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মহিউদ্দিন আজাদ। এরপর থেকে নানামুখী ব্যর্থতার দায়ে চাপে পড়েন এমডি আব্দুল হামিদ মিয়া। এখন দায় এড়াতে পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এমডি।

প্রতিষ্ঠানটিকে খাদের কিনারায় ফেলে এমডির পদত্যাগপত্র দেওয়ার বিষয়টি ভালো চোখে দেখছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তাই আব্দুল হামিদ মিয়াকে যেন কোনোভাবেই পদ থেকে অব্যাহতি না দেওয়া হয়- এ জন্য প্রিমিয়ার লিজিংয়ের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২৮ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে আব্দুল হামিদ মিয়ার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত কার্যকর না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হলো।

এতে আরও বলা হয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত প্রশাসকের পূর্বানুমোদন ছাড়া পরিচালক পদ থেকে আব্দুল হামিদ মিয়াকে অব্যাহতি সংক্রান্ত কোন মেমো পর্ষদ সভায় উপস্থাপন থেকে বিরত থাকার জন্য পর্ষদকে পরামর্শ দেওয়া হলো।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ এর ১৮(ছ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ আদেশ প্রদত্ত হলো বলেও চিঠিতে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পদত্যাগের বিষয়ে জান‌তে চাইলে এম‌ডি আবদুল হামিদ মিয়া ঢাকা পোস্ট‌-কে বলেন, ‘আমি পদত্যাগপত্র দিয়েছি ২০২০-এর ৩০ নভেম্বর। ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি। প্রিমিয়ার লিজিংয়ে আমি প্রায় পাঁচ বছর ধরে আছি। আমাদের প্রতিষ্ঠান ভালোভাবেই চলছে। এর আগে দীর্ঘদিন ব্যাংকে কাজ করেছি। লিজিং প্রতিষ্ঠানে অনেকদিন কাজ করলাম। এখন বয়স হয়েছে। ক্যারিয়ারের শেষ সময়টা ব্যাংকে কাটাতে চাই। এ জন্য ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগপত্র দিয়েছি। আজকে শুনলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক আমার এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করার জন্য পর্ষদকে না‌কি চিঠি দিয়েছে। ত‌বে কেন দিয়েছে, এটা আমি জানি না।’

আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং- এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা চাহিদামতো ফেরত দেওয়া হচ্ছে। আমাদের পোর্টফোলিও দেখলেই বুঝতে পারবেন।’

প্রশাসক নিয়োগ প্রসঙ্গে আব্দুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘এক জন আমানতকারী দুই কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আমরা ওই আমানতকারীর টাকা সুদে আসলে ফেরত দিয়েছি। পরে আদালতের নির্দেশে গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দেয়। আমি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার আগেই। এখানে প্রতিষ্ঠানের দায় এড়ানো কোনো বিষয় নেই।’

২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে প্রিমিয়ার লিজিং। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মোট সম্পদের পরিমাণ এক হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। যা ২০১৭ সালে ছিল এক হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির আমানত রয়েছে ৮১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক আমানত। যার বেশিরভাগই ফেরত দিতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং। আর প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ এক হাজার ২৫১ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রায় ৯০০ আমানতকারীর জমা ৯৫ কোটি টাকা রয়েছে। আমানত হিসেবে রাখা এ অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। প্রিমিয়ার লিজিং ঋণ, মেয়াদি আমানত ও কলমানি হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার করেছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ অর্থ ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

Exit mobile version