নিষেধাজ্ঞার মুখেও অটল ইরান, অবশেষে কি নতিস্বীকারে বাধ্য হবে যুক্তরাষ্ট্র!
ইরান – যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক আবহকে উত্তপ্ত করে রেখেছে। এ দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি সময়ে তা আরও জটিল হয়ে উঠছে। যা মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে এসেছে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। ইরানের খনিজ সম্পদ, পারমাণবিক শক্তি উস্কে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ মানসিকতাকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইসরায়েল। এই পরিস্থিতির শেষ কি আদৌ কূটনৈতিকভাবে সম্ভব? নাকি এর শেষ পরিণতি যুদ্ধই? এই প্রশ্নগুলো বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। একনজরে দেখে নেয়া যাক সম্প্রতি এই ত্রয়ীর কার্যবিধি।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না ইরান
ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে বৈঠকের যে প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল, তা ফিরিয়ে দিল ইরান। ইরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে– যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুললে কোনো রকম আলোচনায় বসা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খাতিবজাদেহ রোববার বলেছেন, পরমাণু সমঝোতার ব্যাপারে ইউরোপ সম্প্রতি যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে, তার জন্য বর্তমান সময়কে উপযুক্ত মনে করছে না তেহরান।
বাইডেন সরকার পরমাণু চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনায় রাজি হলেও ইরানের ওপর থেকে এখনই নিষেধাজ্ঞা তোলার ব্যাপারে প্রস্তুত নয়। যদিও ইরান কোনোরকম আলোচনায় যেতে প্রস্তুত নয়।
এদিকে, ইরান যেমন ক্রমাগত দেশে ইউরেনিয়ামের মজুদ বাড়াচ্ছে, তেমনই পরমাণুকেন্দ্রগুলোর ছবি জাতিসংঘকে দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
ইরানের সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করল বাইডেন
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খাতিবজাদেহ পরমাণু সমঝোতা নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বসার ইউরোপীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় হতাশা প্রকাশ করেছে বাইডেন সরকার। সাঈদ খাতিবজাদেহ জানান, এই সমঝোতার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও তিন ইউরোপীয় দেশের সাম্প্রতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে ইরান আলোচনায় না বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
খাতিবজাদেহর বক্তব্যের পরপরই হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেন, আমরা ইরানের প্রতিক্রিয়ায় হতাশ হলেও একই সময়ে দুপক্ষের এই সমঝোতায় ফিরে আসার লক্ষ্যে অর্থবহ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে নিজেদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করছি।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটন পরমাণু সমঝোতার বাকি পাঁচ দেশ চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ব্রিটেন ও জার্মানির সঙ্গে আলোচনা করবে ওয়াশিংটন।
আমেরিকা কি নতিস্বীকার করবে!
সোমবার কয়েকটি তেল ও গ্যাস প্রকল্প উদ্বোধনের সময় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, আমেরিকাই ইরানি জাতির কাছে নতিস্বীকার করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে।তিনি আরও বলেন, আমেরিকার নয়া সরকার এ পর্যন্ত চার বার স্বীকার করেছে যে তাদের সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি ব্যর্থ হয়েছে। এটা ইরানি জাতির জন্য বড় বিজয়। কারণ যারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তারাই নিজের মুখে স্বীকার করছে তাদের নিষেধাজ্ঞায় কাজ হয়নি।
ইরানি হুমকি থেকে সৌদিকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথমবারের মতো সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সঙ্গে ফোন আলাপে ইরানি হুমকির হাত থেকে সৌদি আরবকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সৌদির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসপিএ (সৌদি প্রেস এজেন্সি) জানিয়েছে, সৌদি আরবকে যেকোনো হুমকি থেকে সুরক্ষা দিতে ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুতির জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বাদশাহ সালমান। এ ছাড়া ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে দেওয়া হবে না বলে নিশ্চয়তাও দিয়েছেন বাইডেন। এছাড়া, সৌদিতে সম্প্রতি লুজাইন আল-হাথলুলসহ অন্য মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তি দেওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাইডেন। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন তিনি।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতি অনুসারে, জো বাইডেন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যতটা সম্ভব মজবুত ও স্বচ্ছ করতে যা যা প্রয়োজন, তার সব করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাদশাহ সালমানকে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব
মধ্যপ্রাচ্যে এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল ইরান। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ এ সময় মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয় পারস্য উপসাগরের দেশটি।
এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোন অনুরোধই এসময় ফেলেননি শাহ।১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ দুই সপ্তাহ পর দেশে ফেরেন নির্বাসিত নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনি। তিনি ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবের’ নেতৃত্ব দেন।
ওই সালের ১৬ জানুয়ারি রেজা শাহ ক্যানসার চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় যান। অত্যাচারী শাহকে পৃষ্ঠপোষকতা করার প্রতিবাদে ও তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে বিপ্লব সফল হওয়ার দুই সপ্তাহ পর তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা প্রবেশ করে। এরপর ৪৪৪ দিনের জন্য বন্দী করা হয় ৫২ আমেরিকান।
এরপরি ইরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। দেশটিতে মার্কিন পণ্য রপ্তানি ও তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। জব্দ করা হয় ইরানের ১২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ। বের করে দেয়া কূটনীতিকদের। ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
পরবর্তীতে এক বছরের মধ্যে ইরান আক্রমণ করে সাদ্দাম হুসেন। আট বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, অর্থ, সামরিক প্রযুক্তি এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও সরবরাহ করে। এসময় লেবাননে ইরানের সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর হামলায় বৈরুতের একটি ব্যারাকে ২৪৪ আমেরিকান নিহত হয়।
ইসরায়েলর সাথে সম্পর্কের অবনতি
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান। ১৯৫০ সালে এ স্বীকৃতি দেয় ইরান। রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷
তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ইসরাইলি জাহাজ বিস্ফোরণে দায়ী করা হল ইরানকে
ওমান থেকে ইসরাইলি জাহাজ এমভি হিলিয়াস রেতে গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। এ বিস্ফোরণে জাহাজটিতে একাধিক ছিদ্র হয়। এ হামলার দায় কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও ইরানের কট্টরপন্থি দৈনিক কায়হানের একটি খবরে বলা হয়েছে, তেহরানই ওই হামলা চালিয়েছে।
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জাহাজটির কোনো ক্রু হতাহত হয়নি। বন্দরের দিকে অংশ দুটা গর্ত দেখা গেছে জাহাজের গায়ে এবং পানির দিকে অংশে দুটা।
সূত্র মতে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর জাহাজটি আরব উপসাগরে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এ কারণে এতে ইরান হামলা চালায়। হামলার পর জাহাজটি বর্তমানে মেরামতের জন্য দুবাইয়ের রাশিদ বন্দরে নিয়ে আসা হয়েছে। ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের জলসীমায় নানা উত্তেজনার মধ্যে ইসরাইলি জাহাজে এই বিস্ফোরণ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
এদিকে, ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গানৎজ জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, জাহাজটিতে বিস্ফোরণের জন্য ইরানই দায়ী।
পাল্টা আঘাতের জন্য বদ্ধ পরিকর ইসরায়েল
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ওমান উপসাগরীয় এলাকায় ইসরায়েলি মালিকানাধীন জাহাজে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ইরান।
ইসরায়েল পাল্টাঘাত করবে কি না জানতে চাইলে নেতানিয়াহু বলেন, আপনারা আমাদের নীতি জানেন। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরান। আমি পাল্টাঘাতের জন্য বদ্ধপরিকর। আমরা পুরো অঞ্চলে হামলা চালাচ্ছি।
ইসরায়েলের এই অভিযোগ অস্বীকার করে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সায়্যিদ খতিবজাদেহ বলেছেন, আমরা এই অভিযোগ তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। পারস্য উপসাগরের নিরাপত্তা ইসরায়েলের জন্য চরম গুরুত্বপূর্ণ। এমন অভিযোগের মাধ্যমে অঞ্চলটিতে আতঙ্ক ছড়াতে দেব না আমরা।