অনিয়ম চাপা দিতে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) শাহ আলমসহ অন্যদের পিপলস লিজিং থেকে সাত বছরে (২০০৯-১৫) সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে ‘কিছু ভিআইপি ব্যক্তির জন্য মূল্যবান গিফট ক্রয়’ করা হয়েছিল বলে নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেছেন। পি কে হালদারের সহযোগী হয়ে প্রায় ৭১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি দুদক তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসে। সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের দ্বিতীয় দিনই তিনি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক। জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো ২ লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘এসব কথা শতভাগ মিথ্যা। আমি পলিসি ডিপার্টমেন্টে ছিলাম। এর সঙ্গে অডিটের কোনো যোগসূত্র নেই।’
উজ্জ্বল কুমার নন্দী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সিএ ফার্মে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কোর্সে যোগ দেন। ২০০৮ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে চাকরি শুরু করেন। ২০১০ সালে গোল্ডেন ইনস্যুরেন্সে সিএফও হিসেবে যোগ দেন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেছেন, আইআইডিএফসিতে থাকার সময় সেখানে ডিএমডি ছিলেন পি কে হালদার। সেখান থেকেই পি কে হালদারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ২০১৩ সালে গোল্ডেন ইনস্যুরেন্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। তখন নতুন গ্রাহকের খোঁজে যোগাযোগ করলে পি কে হালদার তাঁর বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে পরামর্শকের কাজ করার প্রস্তাব দেন।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেছেন, নর্দান জুট মিলস কেনার জন্য তিনি সরেজমিনে পি কে হালদারের সঙ্গে যান। পি কে হালদার তাঁকে মিলটির পরিচালক হতে বলেন। তাঁর কাছে কোনো টাকা না থাকায় পি কে হালদার নর্দান জুট মিলের ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকার শেয়ার তাঁর (উজ্জ্বলের) নামে কেনেন। পি কে হালদারের সহযোগী অমিতাভ অধিকারীও এই কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। এই নর্দান জুট মিলের অনুকূলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের টাকা চলে যেত রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেছেন, তাঁকে আনাম কেমিক্যালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে পি কে হালদার প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা করে বেতন হিসেবে দিতেন। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ঋণের দায় ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আনানের নামে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের টাকা অমিতাভ অধিকারীর সহায়তায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ ওয়াকামা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, দিয়া শিপিং, বর্ণ, নিউট্রিক্যাল, আরবি এন্টারপ্রাইজ ও সুখাদা লিমিটেডের হিসাবে সরিয়ে নেন পি কে হালদার।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেছেন, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের নামে তাঁরা ৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ নেন। ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের নামে ঋণ নেওয়া হলেও এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, এসএ এন্টারপ্রাইজ, রেপটাইল ফার্মসের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী আরও বলেছেন, পি কে হালদার বিভিন্ন সময় তাঁকে বিভিন্ন দেশে প্রমোদের জন্য পাঠাতেন। তিনি তিনবার মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। এর মধ্যে দুবার পি কে হালদারের সঙ্গে। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কেনার বিষয়ে আলোচনার জন্য তখন অমিতাভ অধিকারী, রাজীব সোমও মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে গিয়েছেন দু-তিনবার। এসব ভ্রমণে তাঁর সঙ্গী হতেন রাজীব সোম, অমিতাভ অধিকারী, অবন্তিকা বড়াল, নাহিদা রুনাই। সব খরচ পি কে হালদার বহন করতেন। এ ছাড়া সিমটেকের সিদ্দিকুর রহমান, জেড এ অ্যাপারেলসের মো. জাহাঙ্গীর আলম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদ রেজা ছিলেন পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে প্রত্যেকেই উপকৃত হয়েছেন।উজ্জ্বল কুমার নন্দী জবানবন্দিতে বলেছেন, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁর ছিল না। পি কে হালদার তাঁকে এ চেয়ারে বসিয়েছেন এবং সবকিছু পরোক্ষভাবে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করতেন। আগের চেয়ারম্যান ছিলেন ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম। তিনি পদ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে পি কে হালদার চেকের মাধ্যমে তাঁকে ১২ কোটি টাকা ঘুষ দেন। এরপর তিনি পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেছেন, তিনি পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় মর্টগেজ করা ৬৬ কাঠা জমি বিক্রিসংক্রান্ত বিষয়ে অনিয়ম হয়েছে। জমিটি পিঅ্যান্ডহাল ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিক্রি করা হলেও কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল, হাল এন্টারপ্রাইজ, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, হাল ট্রাভেল এবং এফএএস লিজিং থেকে এই অর্থ পরিশোধ করা হয়। সবই পরোক্ষভাবে পি কে হালদারের কোম্পানি। জমি বিক্রির ১২০ কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব টাকা আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিংয়ে স্থানান্তর হয়েছে। ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম জমিটি বিক্রি বাবদ ৬ কোটি টাকা পি কে হালদারের কাছে ঘুষ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম গণমাধ্যমকে বলেন, পি কে হালদারের গ্রুপটিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন। শত্রুরা এখন তাঁকে জড়িয়ে অনেক কিছুই বলতে পারে।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেছেন, পি কে হালদার ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরীর কাছে ১২৭ কোটি টাকা দিয়ে কক্সবাজারের র্যাডিসন হোটেল কেনেন। পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিংয়ের এমডি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কৌশলে ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে সেখান থেকে অর্থ বের করে হোটেলটি কিনেছিলেন। এ ছাড়া আবদুল আলিম চৌধুরীর সহায়তায় তিনি দুবাইসহ অন্যান্য দেশে অর্থ পাচার করেছেন। মূলত পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিং থেকে বিভিন্ন কায়দায় ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বের করেন এবং পরে চাপে পড়ে গেলে একই কায়দায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বের করে রিলায়েন্সের দেনা পরিশোধের চেষ্টা করেছিলেন।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বের আগের পর্ষদের একাধিক সদস্যের দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ ও অনিয়মেরও বিবরণ দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেছেন, তাঁদের সব অপকর্ম ঢাকতেই ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, জিএম শাহ আলমসহ অন্যদের ১ কোটি টাকা করে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল।