কিছু ব্যাপারে একটু মুখ খুলবো আজ। ছবিতে যে বোরকা পরিহিত মেয়েটিকে দেখছেন সে আর কেউ নয়, আমি নিজেই। আজ থেকে ৬ বছর আগে চোখেমুখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা এসেছিলাম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি জগন্নাথে চান্স পাওয়ার আগেও আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় চান্স পেয়েছিলাম। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে মেয়েদের চলাফেরা পোশাক দেখে ভড়কে গিয়েছিলাম (যদিও এখন এসব আমার কাছে কিছুই না, প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দের পোশাক পরার অধিকার আছে)। কিন্তু তখন অনুভূতি ছিল এমন যে, আমি মফস্বলের বোরকা পরিহিত সাধারণ মেয়ে মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়টা আমার জন্য না। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যখন দেখি ক্লাসের ৮০% মেয়ে বোরকা পরে আসে তখন খুব ভালো লাগছিল, কমফোর্ট ফিল হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমার জন্য জগন্নাথই উপযুক্ত।
এখনো যখন এমন খবর শুনি যে জাহাঙ্গীরনগরে বোরকা পরার কারণে কিছু মেয়েরা টিচারদের ক’টূক্তি ও অ’পমানের শি’কার হচ্ছে তখন খুব খারাপ লাগে। ধর্মীয় বিবেচনা বাদ দিলাম, সাধারণভাবে ভাবতে গেলেও যদি কোন মেয়ের জিনস প্যান্ট-শার্ট পরার স্বাধীনতা থাকে তবে বোরকা পরাও তার নিজস্ব ইচ্ছা স্বাধীনতার ব্যাপার।
এ ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া টিচারগুলো নিঃসন্দেহে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি। মুক্তমনা হতে হলে নি’রপেক্ষতা, উদারতার গুণ আগে অর্জন করতে হয়। সব শ্রেণির, সব ধর্মের, সব পোশাকের মানুষকেই যদি তুমি শ্রদ্ধা না করতে পারো তবে তুমি কিসের মুক্তমনা? তুমি তো মূলত মুক্তমনার ছদ্মবেশে ব’দ্ধমনা। উদারতা ছাড়া উগ্র গণ্ডিমার্কা মুক্তমনা আর ধর্ম নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা কুয়োর ব্যাঙ মার্কা ধার্মিক একই।
এদের মধ্যে জাতগত পার্থক্য থাকলেও গুণগত কোন পার্থক্য নেই। এবার গা ঘেঁ’ষা প্র’সঙ্গে আসি, জবিতে ভর্তি হওয়ার পর নতুন নতুন ঢাকায় এসেছি, রাস্তায় চলাচলে অনেক কিছুই ভ’য় ভ’য় লাগত। রামপুরা বোনের বাসা ছিল। প্রথম ৩ মাস বোনের বাসা থেকেই ক্লাস করেছি, নিয়মিত। বাসে করেই ভার্সিটি আসতে হতো।
এরপর যখন ভার্সিটির দিকে শিফট করলাম তখনো প্রতি সপ্তাহে বাসে করে বোনের বাসায় যেতাম। যথারীতি বোরকা পরেই বের হতাম। কোন কারণে বাসে কোন বিকৃতমনা পুরুষের সঙ্গে বসতে হলে খুব অ’স্বস্তিতে পড়ে যেতাম। না পারতাম কিছু বলতে, না ছিল প্র’তিবাদ করার সা’হস, ল’জ্জায় ভ’য়ে জ’ড়সড় হয়ে থাকতাম। * দেখা গেল কোন এক ব’জ্জাতের সঙ্গে বসতে হলো, যে কিনা নানা অজুহাতে নিজের হাত পা নাড়াচ্ছিল, আমার গায়ে লাগানোর জন্য। *
মহিলা সিটে বসলাম, তার সামনেই ইঞ্জিনে বসা বি’কৃতমনা লোকটা নিচে দিয়ে পা দিয়ে আমার পা ঘ’ষছে। * একদিন সাইডের সিটে বসেছিলাম, পাশেই দাঁড়ানো এক লোক তার পু-রুষা’ঙ্গ দিয়ে আমার বাহুতে ঘ’ষছিল। * ভিড়ের মধ্যে বাসে দাঁড়িয়েছিলাম একদিন, এক লোক পাছায় হাত ঘ’ষছিল ইচ্ছে করে। * বাসের হাতল ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, এক ছেলে বারবার ইচ্ছা করে হাতের ওপর হাত রাখছিল, অথচ হাত রাখার জায়গার অভাব তেমন ছিল না বাসে। *
একদিন সিটে বসে লক্ষ্য করলাম পেছন থেকে কেউ সিটের ফাঁক দিয়ে পিঠে হাত দিচ্ছে। * একদিন বাসে তাড়াহুড়ো করে ওঠার সময় খেয়াল করলাম পেছন থেকে কেউ বা’জেভাবে হাত দিচ্ছে বারবার, ফিরে তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম না কে করছে এটা কারণ ভিড় ছিল, আর বাসে না উঠেও উপায় ছিল না। * আরেকদিন বাস থেকে নামার সময় খেয়াল করলাম, এক দাড়িসমেত এবং টুপি পরিহিত ভদ্রলোক বাসের সিঁড়িতে ইচ্ছা করে আমার পেছনে তার হাঁটু দিয়ে অনেক জো’ড়ে গুঁতো দিয়েছিল। এতটাই জো’রে যে বাস থেকে ছি’টকে পরতে পরতে কোন রকমে সোজা হতে পারছিলাম। * রাস্তা দিয়ে চলার সময় একইভাবে আরেক ভদ্রবেশী হুজুর কনুই দিয়ে আমার বক্ষে অনেক জোরে গুঁতো দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গিয়েছিল, আমি অনেক ব্য’থা পেয়েছিলাম সেদিন। ভাইরে বিশ্বাস কর বা না কর তাতে কিছু যায় আসে না, এই ঘটনাগুলো আমার সঙ্গেই ঘটছে,
বোরকা পরিহিত অবস্থায়, তাও একবার না বহু বহুবার, যতবার বাইরে বের হয়েছি ততবারই কোন না কোন বি’কৃতমনা তাদের বিকৃত স্পর্শে ক্ষতবিক্ষত করেছে আমার সরল মনটাকে। শুধু আমি মেয়ে বলে তা নয়, মায়ের মত বয়স্ক আন্টিদের সঙ্গেও তারা একই কাজটাই করে কারণ মাং’সপিণ্ড তো, হিং’স্র প্রাণীর কাছে সব মাংসই মজা, হোক তা কাঁচা বা পরিণত। দুধের শিশু ছাড়া সবাই জানে এবং খুব ভালোভাবেই কল্পনাও করতে পারে যে, বোরকার নিচেই নারীর একটি আকর্ষণীয় দেহ আছে, এক জোড়া ব’ক্ষ আছে, একটা মাং’সল কোমর আছে, নিতম্ব আছে।
আর যারা ওই মাংসল দেহটার বিকৃত লা’লসায় পড়ে আছে, তাদের সামনে কোন পোশাকই বাধা না, সাতটি বোরকা পরে গেলেও তারা কল্পনায় নারীর রূপ দেখতে পায় এবং সুযোগ পেলেই স্প’র্শ করে। বরং আজব মনে হলেও সত্য যে, বোরকাওয়ালীদের আরও বেশি স্প’র্শ করে কারণ এই মেয়েরা স্বভাবতই একটু ভিতু, আর তাদের চ’ক্ষুলজ্জাবোধটা অর্থাৎ প্র’তিবাদ করলে লোকে কী বলবে এই বোধটা তাদের অনেক বেশি থাকে, তাই তারা কিছু না বলে চুপচাপ সহ্য করে যায়। বি’কৃতমনা ন’পুংশ’কদের দ্বা’রা শিশুরা আজ এ জন্যই বেশি ধ* হয় কারণ তারা দু’র্বল, সরল, প্রতিবাদহীন, আর ওইসব বি’কৃতরা এ রকমই সুযোগ চায়। আমি দেখেছি, বি’কৃতমনারা বরং জিনস পরা মেয়েদের ভ’য় পায় বেশি। কারণ, ওই মেয়েরা চ’ক্ষুলজ্জার জাত মে’রে দিয়ে বি’কৃতমনাদের গেড়ে ফেলে দেয় জায়গাতেই।
বিধাতা আমাদের এ অ’ঙ্গগুলো দিয়েছে পৃথিবীর প্রয়োজনে, আমরা বিধাতার কাছ থেকে পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য অনুরোধ করে, ভিক্ষা করে এই অঙ্গগুলো আনিনি। আমরা বিধাতার পৃথিবী টিকিয়ে রাখতে এই মাতৃকুল আবির্ভূত হয়েছি। মা হওয়ার জন্য অঙ্গগুলো নিয়ে জন্মেছি, আমাদের সন্তানদের পরম আদরে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা এই অঙ্গগুলোর অধিকারী হয়েছি এবং এ পৃথিবীর অস্তিত্বকে যত্নে টিকিয়ে রাখার জন্য জন্মেছি।
কখনো কি কোন মেয়ের বক্ষ যুগলের দিকে তাকিয়ে একবার ভেবে দেখেছেন এ রকম দুটি বক্ষই একসময় আপনার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল? আমরা তো মানুষ, আমাদের মা আছে, মায়ের ভালোবাসা আছে বলেই তো আমরা মানুষ। যেই মেয়েটিকে আজ মাগি বলে গালি দিচ্ছেন, সেই মেয়েটিই একদিন ‘গি’ ব্যতীত ‘মা’তে পরিণত হবে যার পায়ের নিচেই রচিত হবে সন্তানের বেহেশতখানা।
ইসরাত জাহান: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়