পরমাণু বিজ্ঞানী ফখরিজাদে হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবার সময়টা ইরান নিজেই বেছে নেবে

ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদে হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবার অঙ্গীকার করেছেন দেশটির নেতারা। তারা বিশ্বাস করেন, ইসরাইলই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তবে এর প্রতিশোধ ‘ইরান যখন সঠিক সময় এসেছে বলে মনে করবে তখনই’ নেয়া হবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, হঠকারী কোন কিছু করা হবে না এবং প্রতিশোধ নেবার সময়টা ইরান নিজেই বেছে নেবে।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে ইরানের মাটিতে আক্রমণ চালিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিকে হত্যা করে দেশটির শত্রুরা এক বিরাট এবং অপমানজনক আঘাত হেনেছে। শুক্রবারের হত্যাকাণ্ডটি নতুন কিছু নয়। এর আগেও চারজন ইরানী পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং সেগুলোর জন্য ইরান ইসরাইলকেই দায়ী করেছে। যে প্রশ্ন সবার মনে আসবে তা হলো: ইরান কীভাবে এর পাল্টা জবাব দেবে? কখন দেবে?

ইরানের প্রেসিডেন্ট কেন এক্ষুণি প্রতিশোধ নেবার কথা বলছেন না?

ইরানের সামরিক বাহিনী বলেছে, ‘বজ্রের মত আঘাত হেনে’ প্রতিশোধ নেয়া হবে।

প্রতিশোধের দাবিতে তেহরানের রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভও করেছে। একজন বিক্ষোভকারী সেখানে বলেছেন, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ক্ষমতার শেষ দুই মাসে একটা ‘যুদ্ধের পরিস্থিতি’ তৈরি করতে চাইছেন।
কিন্তু ইরানের বাস্তববাদী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কথাগুলো ছিল অনেক মেপে মেপে, হিসেব করে বলা। তিনি বলছেন, প্রতিশোধ নেয়া হবে ঠিকই, কিন্তু হয়তো এক্ষুণি তা হবে না।

‘ইরান যথাসময়ে ব্যবস্থা নেবে, ফাঁদে পা দেবে না । তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, কিন্তু আমরা তাদের হাতে কি তাস আছে তা বুঝে ফেলেছি। তারা সফল হবে না। কারণ ইরান জানে, পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের সাথে সংঘাত নয় বরং সংলাপ চান’ – দৃশ্যত: ইসরাইলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন প্রেসিডেন্ট রুহানি।

প্রশ্ন সেখানেই। ইরান কেন এক্ষুণি কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেবার কথা বলছে না?

ইসরাইল আর যুক্তরাষ্ট্র মিলে একটা ফাঁদ পেতেছে?

বিবিসির বিশ্লেষক ও ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক এ্যালান জনস্টন বলছেন, এই সতর্কতার কারণ হলো – প্রেসিডেন্ট রুহানি মনে করেন, ইসরাইলের কট্টর যুদ্ধবাজরা এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে ইরানের জন্য একটা ফাঁদ পেতেছে।
‘তারা চাইছে, ইরান একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এক বড় রকমের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক।’

জনস্টন বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ কয়েকটি সপ্তাহ চলছে এখন। এই সময়টাতে সম্ভবত প্রেসিডেন্ট রুহানি বড় কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়া এড়াতে চাইছেন। তিনি আশা করছেন, ট্রাম্পের বিদায়ের পর জো বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব নিলে ইরানের জন্য একটা অপেক্ষাকৃত ভালো সময় আসবে, হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা যোগাযোগ এবং ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলোও শিথিল করার সুযোগ মিলে যেতে পারে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি এখন চরম সংকটে রয়েছে।

ইরানকে ‘কিছু একটা করতে হবে,’ এমনও মনে করেন কেউ কেউ

তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, ইরানের ওপর চাপ বাড়ছে। এ বছর জানুয়ারি মাসে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হবার পরও ইরান প্রতিশোধের কথা বলেছিল, কিন্তু এখনো তারা সেরকম কিছু করেনি। এর পরই আবার পরমাণু কর্মসূচির এত গুরুত্বপূর্ণ একজনকে হত্যার পর ইরানে প্রতিশোধের স্পৃহা বেড়ে গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্বাস আসিয়ানি বলছেন, এবার হয়তো ইরানকে কিছু একটা করতে হবে।

‘আমার মনে হয় ইরানের একটা জবাব দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তারা যদি কিছু না করে, তাহলে তারা এরকম আরো পদক্ষেপের বিরাট বিপদ ডেকে আনবে, এমনকি ভবিষ্যতে সংঘাতও বাধতে পারে।’

বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সাথে ২০১৫ সালে ইরানের যে চুক্তি হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে একটা সীমার মধ্যে রাখা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে বের করে নিয়ে যাবার পর – ইরান সেই সীমালঙ্ঘন করে ইউরেনিয়াম মজুত এবং সমৃদ্ধ করা শুরু করেছে। হয়তো পরমাণু কর্মসূচির প্রধান মোহসেন ফখরিযাদের ওপর আক্রমণের পেছনে এটা কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে – বলছেন বিবিসির বিশ্লেষক পল এ্যাডামস।

তিনি বলছেন, ইরানের পুরো পারমাণবিক এস্টাব্লিশমেন্টের প্রতি এটা এক হুঁশিয়ারি।

মধ্যপ্রাচ্যের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হয়তো চান ইরানকে আবার আলোচনার পথে নিয়ে আসতে। কিন্তু সেই কঠিন কাজকে আরো কঠিন করে দিয়েছে এই ফখরিযাদ হত্যাকাণ্ড।

মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে এক নিবন্ধে বিশ্লেষক হেনরি অলসেন বলছেন, ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় ইরানের সাথে শক্তিধর দেশগুলোর যে পরমাণু চুক্তি হয় – সৌদি আরব ও উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো তাতে বিচলিত হয়েছিল।

কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ইসরাইল ও উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো জানে যে ইরান তাদের ধ্বংস করতে চায়।

‘অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ইসরাইলের হাতে ইতোমধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে, কিন্তু তা সত্বেও তারা এবং আরব রাজতন্ত্রগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের হুমকির হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষা করবে – এই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করতো।’

কিন্তু ইরানের সাথে ২০১৫ সালের চুক্তিটি সেই আশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

‘ইসরাইল মনে করে, এ চুক্তির অর্থ হলো – কোন একটা সংকটের মুহূর্তে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে এমন নিশ্চয়তা আর নেই। অন্য দিকে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো মনে করছে, ইরানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন অন্য একটি পরমাণু শক্তিধর মিত্র তাদের দরকার’ – বলছেন মি. অলসেন।

হয়তো সেরকম একটা হিসেব মাথায় রেখেই সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইতোমধ্যেই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। কয়েকদিন আগে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে – ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর উপস্থিতিতে – ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বৈঠক হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।

এরকম এক প্রেক্ষাপটে একদিন আগেই ওয়াশিংটন পোস্ট রিপোর্ট করে – ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সপ্তাহগুলোতে ইরাকের মাটিতে ইরানের সাথে কোনো একটা সংঘাত বেধে যায় কিনা – এমন একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল কাদিমির সরকার।

তার ঠিক পরপরই ইরানী পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ড ঘটলো – যার প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে জটিল কোনো ঘটনাপ্রবাহের সৃষ্টি হয় কিনা, তাই বোঝার চেষ্টা করছেন বিশ্লেষকরা। সূত্র : বিবিসি

Exit mobile version